রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

একটি গাড়ী ভাংগার গল্প


                
কাওরান বাজার মোড়ে কিটিদের গাড়ী জ্যামের মধ্যে আটকা পড়ে গেল। উফ, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে একঘন্টা এখানেই আটকে পড়ে আছে। কালকে আবার হরতাল। তাই আজকেই সারিকার বাসা থেকে বাংলা ফার্স্ট পেপারের নোটগুলো নিয়ে আসতে হলো। নয়তো ও আবার পরশুদিন চিটাগাং চলে যাচ্ছে। মা কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। বারবার যেতে মানা করছিল, হরতালের আগের দিন নাকি গোলমাল হতে পারে। এটা অবশ্য একটা নতুন ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। হরতালের আগের দিন ভাংচুর। কিন্তু আম্মু এতো মানা করলেও উপায় তো ছিলনা। নোটগুলো না পেলে এস এস সি র প্রিপারেশন বেশ পিছিয়ে যেত।  যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারলেই বাঁচি। আশে পাশে নিশ্চল গাড়ীর জংগলে কিটি  অবশ্য এই ব্যাপারে খুব একটা আশান্বিত হতে পারছিল না।

জাহিদ চিন্তা করলো আর দেরী করাটা ঠিক হবে না। পান্থপথের মোড়ে সাঈদ রেডি গোটা দশেক সোলজার নিয়ে। আর এফডিসির দিকটা কাভার করছে কালাম আরো গোটা পনের নিয়ে। তার সিগন্যাল পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর পুলিশের ব্যাপারটা বস দেখছেন। বলছে কোন ব্যাপার না। পুলিশ ১৫/২০ মিনিটের আগে কোন কিছুই করবেনা। জাহিদ তার আগেই তার বাহিনী নিয়ে চম্পট দিতে পারবে। গাড়ী পোড়ানোটা ইদানীং একটু  ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায়। একবার ফেটে যেয়ে তো সেলিমের এক সোলজার প্রায় তিনমাস হসপিটালে ছিল। বেচারার ডান পা একেবারে উড়েই গিয়েছিল বলা যায়। 

গাড়ী সবসময় পোড়াতে না পারলেও ভাংচুরটাও কম আনন্দদায়ক নয়। গাড়ী ভাংগার আলাদা একটা আমেজ আছে। হকি স্টিকের  বাকাঁনো ধারটা যখন দমাস করে গাড়ীর সামনের কাঁচটিতে পরে আর তাতে কাঁচের মধ্যে প্রথমে একটি নকশার মত তৈরি হয় মনে হয় যেন কোন এক মহান শিল্প কর্ম। তারপর সেটি একসময় চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। সাথে সাথে যে একটা তীব্র আতংকের ছায়া সবার চোখে মুখে ফুটে ওঠে  তা দেখে নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে হয়। গাড়ীতে প্যাসেঞ্জার হিসেবে নারী এবং শিশুরা থাকলে  জমে আরো ভাল। তাদের তীব্র চিৎকার ভয়ংকর একটা পরিবেশের আমেজ খুব সহজেই এনে দেয়। তারপর সেটা যখন  আলোর চেয়েও তীব্র গতিতে চারিদিকে সংক্রমিত হয়ে যায় তখন মনে হয় এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

জাহিদের বেশ ভাল একটা সুশিক্ষিত দল আছে। অনেকগুলো গাড়ী ভাংগায় অংশগ্রহন করে তারা মোটামুটি বেশ ভাল হাত পাকিয়েছে। শুরুর দিক পঞ্চাশটার মত গাড়ী ভাঙ্গতে প্রায় আধাঘন্টার মত লেগে যেত। ততক্ষনে পুলিশ এসে মোটামুটি বেশ ভালই ঠেঙ্গানো শুরু করতো। বেচারা গিট্টু গালিবের তো কব্জির গিটটাই খুলে গেল মোটা লাঠীর এক মোক্ষম বাড়ি খেয়ে। এখন মোটামুটি ১৫-২০ মিনিটের বেশী সময় লাগেনা। কলেজে পড়ার সময় এক সময় শখের বশে আর উত্তেজনার নেশায় গাড়ী ভাংতো। এখন এটা মোটামুটি একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। এবং বেশ নিরাপদ পেশা।

জাহিদ আগে গাড়ী ভাংতো বিরক্তিকর জীবনে কিছুটা উত্তেজনা খোঁজার জন্য। ক্লাসে কি সব হাবি জাবি পড়ানো হত তা নিয়ে জাহিদ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করতো না। ক্যান্টিনের পিছনে তাসের আড্ডার পাশাপাশি ফেন্সিডিলের বোতলের প্রতিই তার আসক্তি বেশী ছিল। মাঝে মাঝে যখন খবর আসত যে মার্কেটে কোন কর্মচারীর সাথে কলেজের কোন ছাত্রের সংঘর্ষ হয়েছে তখন মারদাঙ্গা ছাত্রদের সাথে মার্কেট ভাংচুর এবং সেই সাথে মার্কেটের সামনে পার্ক করা গাড়ীর উপর এক পৈশাচিক উল্লাসে  জাহিদ ঝাপিয়ে পড়তো। গাড়ী গুলো কি অপরাধ করেছে সেটা নিয়ে অবশ্য তার মাথা ঘামানোর কোন কারণ ছিল না। সে শুধু জানতো কোন একশনে গেলেই  গাড়ী ভাঙ্গতে হবে।

গাড়ী ভাঙ্গাটা নিয়ে তার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সে একটা জিনিস শিখেছে। গাড়ী ভাংগাটা আমাদের সমাজে তেমন একটা গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না।  গাড়ী জিনিসটা এখনও দেশের উপর তলার বড়লোকদের একটি প্রতীক বলেই গণ্য করা হয়। উপরতলার মানুষদের এরকম দু’তিনটা গাড়ী পুড়লে আর কি এসে যায়। এগুলো অবশ্য তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত হয় নাই। একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা যার ছত্র ছায়ায় জাহিদ কাজ করে তার মুখ থেকে শোনা। 

“বুঝলি জাহিদ, নিশ্চিন্তে গাড়ী ভাংবি, গাড়ী ভাংলে এই দেশের লোকজন আসলে কিছুই বলবে না।কিন্ত গাড়ী ভাংলে তুই সহজেই একটা আতংক সৃষ্টি করতে পারবি যা অন্য কিছু করে করে এত সহজে করা যায় না। আর মজার ব্যাপার হলো এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে গাড়ী ভাংলে তোর বিরাট কোন শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বড়জোর পুলিশের দুই তিনটা লাঠীর বাড়ি টাড়ি খাইতে পারিস। এ পর্যন্ত কাউকে দেখছিস গাড়ী ভাংগা বা পোড়ানোর জন্য বিশাল কোন ধরা খাইতে? “ জাহিদ মাথা নেড়ে বলেছে একদম সত্যি কথা। সে এখনও পর্যন্ত দেখে নাই। প্রথম আলোর একদম প্রথম পাতায় ছবি সহ রাজুকে দেখা গেছিলো একটা টয়োটা প্রিমিওর উপর উঠে    লাঠী উচিয়ে রেখেছে। তারপরও রাজুকে শুধুমাত্র কয়েকদিন ডেমরার দিকে পল্টা কামালের বাসায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন তো সে আবার নির্বিকার ভাবে এলিফ্যান্ট রোডে চাঁদাবাজি করছে এবং এই তো গত মাসে ঢাকা কলেজের সামনে একটা   অ্যাকশনে দুইটা করোলা আর একটা নিশান একাই পুড়িয়েছে।

এতদিন জাহিদ বিবেকের মাঝেমধ্যে বিবেকের সামান্য খচখচানি ছাড়া বেশ আত্মতৃপ্তির সাথেই গাড়ি পুড়িয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হল  মাস ছয়েক আগে তাঁর বোনের বাসায় যাওয়ার পর থেকে। তার বোন থাকে কাঁঠাল বাগানের ঢালের কাছে...............

জাহিদ বাসায় ঢুকেই দেখলো আপ্পি সোফায় শুয়ে বই পড়ছে। জাহিদকে দেখেই একটা উৎকন্ঠা আর এক রাশ অনুযোগের ছায়া চোখের মাঝে। “কিরে জাহিদ এতদিন পরে আসলি? আশ্চর্য ব্যাপার! কিটি তো খালি বলে  মামা আর আসে না কেন...মামা আসে না কেন...আশ্চর্য...ফোন করলেও ধরিস না। ফোন টা আছে কি জন্য...ব্যাপারটা কি...এই রকম কেন তুই? “ আপ্পি হড়বড় করে  বলে গেলো।

জাহিদ কিছু না বলে সোফায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগলো।
“কিছু না বলে বেয়াদবের মত চুপ করে বসে আছিস কেন?”
জাহিদ পত্রিকার পাতা থেকে চোখ না তুলেই বললো, “কি বলবো?”
আপ্পি সোফার হাতলের পাশে এসে দাঁড়ালো। একটু চিন্তার ছায়া তাঁর চোখে।
“জাহিদ কিছু হয়েছে নাকি রে? এরকম লাগছে কেন তোকে?” 
“কিছু না আপ্পি, কিটি কোথায় রে?” জাহিদ উঠে কিটির রুমের দিকে রওনা দিল। আপ্পি কিছুক্ষন জাহিদের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকল। তারপরেই তাসলিমাকে দেখেই সম্পূর্ণ অকারণে একটা ধমক দিল “এই দেখিস না যে মামা এসেছে, তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে যা !”

আপ্পির একমাত্র মেয়ে কিটি তো মামা বলতে অজ্ঞান। দুলাভাই যখন বিদেশে ছিলো দু’বছর পোস্ট ডক্টরেট করতে যেয়ে, জাহিদই তখন কিটির দেখাশোনা করতো আপ্পি যখন স্কুলে পড়াতে যেতো।

“মামা!” কিটির মিষ্টি গলার  আহ্ললাদ মেশানো চিৎকারটা আরও অনেক মিষ্টি হয়ে শোনালো অনেক দিন বাদে শোনার ফলে! “জানো জানো আমরা না একটা গাড়ী কিনছি!” কিটির মুখে হাজার ওয়াটের বাল্বের আলো যেন ফেটে পড়ছে।

“তাই নাকি রে, হঠাৎ করে?” জাহিদ বেশ বিস্মিত।

“হ্যাঁ মামা, জানো না তো, নেক্সট উইকের মধ্যেই চলে আসবে।

“ওরে বাবা, এতো তাড়াতাড়ি? আমি তো কিছুই জানিনা”।

“তা জানবি কি করে? তোর কি আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার কোন দরকার আছে?” জাহিদের প্রিয় গরম গরম কুরবানীর মাংস দিয়ে বানানো সমুচা নিয়ে আপা ঢুকতে ঢুকতে বললো।

“একবার গায়েব হলে বেঁচে আছিস না মরে গেছিস তাও জানার উপায় থাকেনা। তোকে এতবার ফোন করে না পেয়ে প্রভোস্টের কাছে ফোন করলাম। তিনি কেমন যেন ঠান্ডা ভাবে কথা বললেন। হ্যারে তুই কি কোন ঝামেলায় করেছিস নাকি? হলে থাকিস...কত রকম ঝামেলা...”

“গাড়ীর ব্যাপারটা কি? হঠাৎ করে? দুলাভাই কি কোন হেরোইন স্মাগলার পার্টির সাথে জয়েন করলো নাকি? এত মাল পাত্তি?” জাহিদ দ্রুত প্রসংগ বদলানোকেই শ্রেয় মনে করলো।

“আরে আরে বলিস না, তোর দুলাভাইয়ের যদি হেরোইন স্মাগলিং করারও মুরোদ থাকতো তাহলেও একটা কথা  ছিলো। সারাদিন মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা, দু’কলম লেখা আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো ছাড়া ওর আর কি করার আছে?” আপ্পি দুলাভাইয়ের প্রতি তাঁর এই চিরন্তন ক্ষোভ দেখানোর সুযোগ কখনই ছাড়ে না।  জাহিদ এতে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।

“তাহলে হঠাৎ করে এতগুলো টাকা...”

এত বছর ধরে ঘোড়ার ডিম কি লেখালেখি  করছে আল্লায় জানে, শেষ বয়সে এসে নাকি মোটামুটি ভাল একটা রিসার্চ গ্র্যান্ট থেকে একটা প্রজেক্ট শেষ করেছে। সেখান থেকে এই সবেধন নীলমণি টাকা। টাকা পেয়েও কি শান্তি...  ফ্ল্যাটের বুকিং দেয়া হবে নাকি গাড়ী কেনা হবে সেই নিয়ে প্রতিদিন আমার আর তোর দুলাভাই এর ঝগড়া। এই ভাড়া বাসায় আর কতদিন? বাড়ীওয়ালার সাথে পানি নিয়ে, ময়লা ফেলা নিয়ে, গেইট নিয়ে এত ঝামেলা …… কিন্তু তার কথা হলো কিটির জন্য গাড়ী কিনতে হবে। এটা ঠিক কিটিকে নিয়ে…. একটু সমস্যা….।“ আপ্পি একটু অস্বস্তির সাথেই বললো।

জাহিদ কিটির দিকে আড়চোখে তাকালো। কিটির সজীব মুখমন্ডলে হঠাৎ করে কালো মেঘের ছায়া। “কেন কি হয়েছে...কিটির?” জাহিদ সাবধানী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল!

 “আর বলিস না, পাড়ার ওই লুচ্চা বদমাইশ লিটন, ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েটার দিকে তার নজর, একদিন তো রিক্সা থামিয়ে..” আপ্পির কন্ঠ হঠাৎ করে বেশ কেঁপে গেল।

“রিক্সা থামিয়ে কি...” জাহিদ জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছিল। কিটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছ।

“রিক্সা থামিয়ে হাত ধরে ওকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল...আমার   
মেয়েটাকে...আমার মেয়েটাকে...জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল...ওই শয়তান লিটন...” আপ্পির গলাটা ধরে আসে। কিটি এই পর্যায়ে হঠাৎ করে উঠে চলে গেল।
“তখন ভাগ্য ভালো মানিক স্যার মাত্র বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ের দোকানে যাচ্ছিলেন। ঘটনা দেখে তিনি যেই এগিয়ে গেলেন অমনি বদমাইশের দল পালালো।“

“লিটনের বাসায় জানানো হয় নাই?” জাহিদের মাথা দপদপ করে জ্বলছে।

“তোর দুলাভাই, মানিক স্যার আর পাড়ার কয়েকজন সেদিন সন্ধ্যায়ই ওদের বাসায় গিয়েছিল। তার বাবা বাসায় ছিলো না। আর লিটন তো গায়েব। তার মা কি বলল জানিস? বললো যে আপনার মেয়েরই তো সমস্যা। সমত্থু মেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন।“

“এই ঘটনার পর আমি মোটামুটি ফ্ল্যাটের আশা পার্মানেন্টলি ছেড়ে দিলাম। ধুর কি হবে নিজের  ফ্ল্যাটে থেকে, যদি একটু শান্তিতে নাই থাকতে পারি। তোর দুলাভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে । রিক্সা আর বাসে  যাওয়া আসে করতে থাকলে এই লিটন শয়তানটা আবার কবে যে কি করে। এই জীবনে মনে হয় আর কোনদিন নিজের একটা বাড়ি হবে না।“ আপুর কন্ঠটা কেমন যেন একটা হাহাকার ধ্বনির মত শোনা গেল।

“আপু, একটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম না। গাড়ী আর বাড়ীর দাম তো এক নয়। গাড়ী কিনার পয়সা দিয়ে কি বাড়ী...”

“আরে তা কি আর হয়। অ্যাট লিস্ট ডাউন পেমেন্টটা তো দেয়া যেতে পারে। আর আমার ননদের চাচাতো ভাই এক বড় ডেভেলপার কোম্পানীর সাথে আছে। ডাউন পেমেন্টা দিতে পারলে অনেক ফ্লেক্সিবল ভাবে ইন্সটলমেন্ট দেয়া যেতো আস্তে আস্তে অনেক দিন ধরে। “ আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

জাহিদ কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই সোফার কোনাটার দিকে তাকিয়ে থাকাটাকে সে শ্রেয় মনে করল।

 হলে ফিরে সে কেন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। রাতের খাবারের সময় খামাখাই ডাইনিং এর বয় দেলোয়ারকে একটা চড় লাগালো ডাল আনতে দেরী করার জন্য। রাতে যখন সামসু আসলো তাসের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন কিছুতেই যেতে রাজী হচ্ছিল না। অনেক জোরাজুরির পরে গেলেও সারাক্ষন গুম হয়ে থাকল।

এক সপ্তাহ পর।

আপ্পির ফোন...রিং টোন বেজেই চলেছে। উফ...আবার একগাদা বকবক...

“হ্যালো”

“মামা!” কিটির রিনরিনে তাজা কৈশোরের সজীব কন্ঠস্বর ভেসে আসল।

“কিটি কুট্টুস, কিরে কি খবর তোর?”

“মামা, তুমি জানো না, আমার কি যে ভাল লাগছে, মামা তুমি জানোনা...উফ আমি মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবো।“ কিটি খুশীর আতিশয্যে হাঁসফাঁস করতে করতে বলে।

“তাড়াতাড়ি বল, অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে গেলে আবার শুনতে পারবো না।“ জাহিদ  হেসে বলল।

“মামা, তুমি জানো না, গাড়ীটা বাসায় যখন প্রথম আনলো, আমি তো মনে হয় একেবারে ফেইন্ট। ক্রীম কালারটা এতো জোস। উফ, আরে গাড়ীর ভিতরের গন্ধটা ,জাস্ট অসাধারন মামা। আমি তো গাড়ী থেকে আর বেরই হচ্ছিলাম না, ড্যাশবোর্ড টা কি ঝাক্কাস, আব্বু তো বললো আমাদের কিটিমণিকে কাঁথা বালিশ এনে দাও। ও আজকে থেকে গাড়ীতেই থাকবে।“ কিটি তার দমের শেষ বিন্দু পর্যন্ত ব্যবহার করার পর থামল।

“গাড়ী চলে এসেছে? বাহ।“ জাহিদ বেশ জোর করেই উল্লাস প্রকাশ করার চেষ্টা করল।

“হ্যাঁ মামা, ওই শয়তান লিটনটার নাকের উপর দিয়ে আমি যখন গাড়ী নিয়ে ধা করে বেড়িয়ে যাবো না, তখন বুঝবে পাজী বদমাইশটা  কত ধানে কত চাল।“ কিটির কন্ঠে একটা পরিষ্কার নিরাপত্তা মিশ্রিত তৃপ্তির ছাপ।

সেদিন রাতে জাহিদ আবার দেলোয়ারকে লবন কম দেয়ায় বিশ্রী ভাষায় গালি গালাজ করলো। তারপর  সামসুর সংগে  ক্যাটরিনা কাইফ না প্রিয়াংকা চোপড়া কে বেশী ভাল অভিনেত্রী এটা নিয়ে তর্ক করতে করতে আরেকটু হলে সামসুকে ঘুষি মেরেই বসতে গেলো।

ছয় মাস পরের কথা।

রিং টোন বাজছে। “হ্যালো”...

“হরতালের ডেট পড়ছে দেখছোস? এইবার তো কড়া হরতাল হইবো মনে হইতাছে।“ সাঈদের গলায় চাপা উল্লাস।

“কিভাবে বুঝলি? বস কিছু বলছে ?”

“বলছে মানে? হাই কমান্ড থেকে ডাইরেক্ট নির্দেশ। একদম ছাড়খাড় কইরা দিতে হইব।“

“মালপানি কি রকম?”

“দোস্ত এইবার একশন যেইরকম কড়া, মালপানি তার চেয়েও বেশী কড়া।“ এই বলে সে গলা নামিয়ে একটা সংখ্যা বললো।

“বলিস কি!”

“আরে দোস্ত এই একশনটা ভাল মত নামাইতে পারলে অনেকদিন আর কোন চিন্তা নাই। বস কিন্তু তোর কথা বার বার বলছে। বলছে যে ছেলেটার হাতের কাজ ভাল।“

...............একটা হর্ণের আওয়াজে জাহিদ সম্বিৎ ফিরে পায়। ওকে, সব রেডী মনে হচ্ছে। জাহিদ দু’টো নাম্বারে দু’টো মেসেজ পাঠালো অতি দ্রুত।  আর তাতে মুহুর্তের মধ্যে পান্থপথ একটা পৈশাচিক রণক্ষেত্রে পরিণত হল।

আহ, কি উত্তেজনা, কি দারুন। কালাম আর সাঈদের দল থেকে আসা ছেলে গুলো মন্দ নয়। দশ মিনিটের মধ্যে তারা মোটামুটি বিশ পচিশটা গাড়ী নামিয়ে ফেলেছে। আজকের গাড়ী গুলোতে বাচ্চা আর মেয়েদের সংখ্যা বেশী। তাই তাদের আতংক ভরা উথাল পাথাল চিৎকারে মোটামুটি আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। জাহিদ বেশ একটা সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে তার পরবর্তী টার্গেটের দিকে এগিয়ে গেল। এই গাড়ীটা তো বেশ ঝা চকচকে মনে হচ্ছে। মনে হয় মাত্র কয়েকদিন আগে পোর্ট থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখনও পার্মানেন্ট লাইসেন্স প্লেট পায় নাই। নিসান ব্লু বার্ড সে আগে কখনও ভাঙ্গেনি। জাহিদ বেশ আগ্রহ নিয়ে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।

গাড়ীটার কাছে আসতেই সে একটা জান্তব আওয়াজ শুনতে পেল। ড্রাইভার তার দিকে  করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছে। আর আরোহী একজন কোট-টাই ভরা ভদ্রলোক, শুন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

জাহিদ বনেটে ভর দিয়ে ছোট্ট লাফ দিয়ে উঠে পড়লো গাড়ীর উপরে। হকি স্টীকটা এক পাক ঘুরিয়ে যেই নামিয়ে আনতে যাবে অমনি তার চোখ চলে গেল দশ/পনেরোটা গাড়ি পিছনে একটা ক্রীম কালারের গাড়ীর দিকে। গাড়ীর পিছনে একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়ে বসে রয়েছে। অবাক কান্ড, এত ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও কিন্ত সে কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে শুধু তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কালামের দলের একজন সোলজার এই মাত্র ক্রীম কালারের গাড়ীটার কাছে পজিশন নিয়ে ফেলেছে।

জাহিদ বিদ্যুৎ বেগে নিশান থেকে নেমে আসল একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে। “এই হারামজাদা থাম। খবরদার এই গাড়ীতে হাত দিবিনা, খবরদার।“ চারিদিকের ভাংচুর আর আর্তনাদের তীব্র আওয়াজে জাহিদের চিৎকার কোথায় হারিয়ে গেল। সোলজার ততক্ষনে একটা মোক্ষম বাড়িতে উইন্ডশীল্ড চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে। ড্রাইভার বের হতেই দেখা গেলো তার মাথা থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছে। “আফা বাইর হন তাড়াতাড়ি, এরা মানুষ না, অহন সাইডের গেলাসে মারবো। গাড়ী ভর্তা কইরা ফালাইবো আফা! বাইর হন অক্ষনি!“

জাহিদ ছুটছে, পনের/বিশটা গাড়ির দুরত্বকে তার অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে। এরকম অবস্থার মধ্যেও সে একটা জিনিস খেয়াল না করে পারলো না। কিটির দৃষ্টিতে কিন্তু কোন রাগ বা ঘৃণার ছাপ নেই। তার  বড় বড় অভিমান ভরা চোখদুটো শুধু যেন বলছে, মামা তুমি এটা কি ভাবে পারলে?

পুনশ্চঃ উপরের গল্পের প্রতিটি চরিত্র এবং গল্প কাল্পনিক হলেও গল্পটি নিবেদিত বাস্তবের গাড়ী ভাংগার নায়কদের উদ্দেশ্যে। আপনি যেই কারনেই গাড়ী ভেঙ্গে থাকুন না কেন, সেটা হোক চরম আক্রোশে, নিছক উত্তেজনায় বা পেশাগত কারণে মনে রাখবেন অনেক গাড়ী এখন মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন একটি অপরিহার্য বিষয়। একটি গাড়ীর পিছনে হয়তো আছে একজন বাবা অথবা মায়ের সারাজীবনের চাকুরীর পেনশনের টাকা বা ব্যবসার পুজিঁ। এর সাথে হয়তো মিশে আছে ঢাকা নামের এই দুর্বিষহ নগরে প্রিয় সন্তানের একটু স্বস্তির সাথে চলাচলের নিরাপত্তা। একটি গাড়ী ভাংগার সাথে সাথে আপনি সেই পরিবারের অনেকগুলো স্বস্তি এবং নিরাপত্তার বাতাবরণ ভেংগে দেন, বিশাল আর্থিক ক্ষতির কথা বাদই দিলাম। পরবর্তী গাড়ীটি ভাংগার আগে ব্যাপারটি কি একটু মাথায় রাখবেন প্লীজ?


1 টি মন্তব্য: