রবিবার, ১২ জুন, ২০১১

সর্বনাশা মুক্ত বানিজ্য



পটভূমিকাঃ গল্পটি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের অর্থনীতি বইয়ে বর্নিত ঘটনার ছায়া অবলম্বনে । গল্পটির অবতারনা এবারের বাজেট থেকে। এবারের বাজেটে দেখলাম দেশীয় শিল্পকে উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ বিদেশী জিনিসপত্রের উপর ট্যাক্স বসানো হয়েছে। এটা খুবই একটা পপুলার চিন্তা। দেশের পণ্য কিনে হও ধন্য টাইপের। আচ্ছা ভাল কথা। এখন যদি আমেরিকা বা ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন চিন্তা করে যে তাদের দেশের লোকজনকে দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারকদের ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। সে জন্য তারা বাংলাদেশ থেকে আগত গার্মেন্টস এর উপর ট্যাক্স বসিয়ে দিল। তাহলে ব্যাপারটা কি রকম হবে? মুক্ত বাণিজ্যে যে কোন বাধার পরিণতি এই গল্পের মত না হলেও অনেকটা একই টাইপের!
--------------------------------------------------------------------------
কুদ্দুস গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রীসের  হেড কোয়ার্টার। দোতলার চীফ এক্সিকিউটিভের অফিস।
  
“এটা কি করে সম্ভব? এটা তো শিল্প আইনে নিষেধ।“ জনাব কুদ্দুস চোখ বড় বড় করে তার বড় ছেলে ইদ্রিসের দিকে তাকিয়ে বললেন। 
  
“বাবা, এইটা কোন ব্যাপারই না, এইটা আমি সামলাবো। কেউ কিছু টের পাবে না।“ ইদ্রিস হেসে বাবাকে আশ্বস্ত করল।


“কি জানি বাবা, ব্যাপারটা কিন্তু আমার মোটেও ভাল ঠেকছে না।“ কুদ্দুস সাহেব বেশ অস্বস্তির সাথে বললেন।

কুদ্দুস গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিস হচ্ছে ‘বোকার স্বর্গ’ নামক দেশটির একটি নাম করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।  ‘বোকার স্বর্গ’ স্বাধীনতার পর থেকেই কঠোর বিশ্বায়ন বিরোধী। শুরু থেকেই স্বদেশী পণ্য কিনে হও ধন্য এই নীতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশ্বাসী।  যার ফলে তারা বাইরের দেশ থেকে কোন কিছু আমদানী করে না। এটা সেই দেশে আইন করে নিষিদ্ধ।  যেমন তাদের যে ইস্পাতের দরকার ভারী শিল্প চালানোর জন্য সেটা তারা নিজেরাই তৈরী করে। কিন্তু উন্নত ইস্পাত তৈরীর কাঁচামাল বা টেকনোলজি কোনটাই দেশটিতে নেই। যার ফলে তারা নিকৃষ্ট জাতের কাঁচামাল দিয়ে  মান্ধাতা আমলের কারিগরি বিদ্যা দিয়ে খুবই নিম্নমানের ইস্পাত তৈরী করে। শুধু তাই নয় এই ইস্পাতের দাম ও অনেক বেশী পড়ে যায় উন্নতমানের প্রযুক্তির অভাবে। যাই হোক এভাবেই বেশ কিছু ইস্পাত কারখানা আস্তে আস্তে গড়ে উঠছিল এবং এভাবেই তাঁরা চলছিল। 

একদিন হঠাৎ দেখা গেলো কুদ্দুস সাহেব তাঁর বানিজ্য সাম্রাজ্যে যোগ করলেন কুদ্দুস এন্ড সন্স স্টীল মিল। এটি প্রতিষ্ঠার খুব অল্পদিনের মধ্যেই ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে গেল। কারণ  খুব কম খরচে তারা অন্যান্য কারখানার  চেয়ে ইস্পাত বিক্রি করে। অন্যান্য কোম্পানি যেখানে প্রতি মে টন ইস্পাত ৬০০০ বোকা ইউনিটের নীচে বিক্রি করতে পারে না সেখানে কুদ্দুস স্টীল মিলস কিন্তু বিক্রি করছে মাত্র ২৮০০ বোকা ইউনিটে। শুধু তাই নয়, ইস্পাতগুলো যথেষ্ট শক্ত এবং মজবুত, সহজে মরিচা ধরেনা। আর অন্যান্য কোম্পানির ইস্পাত নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।


কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো কুদ্দুস স্টীল মিলসের মূল ফ্যাক্টরীটি দেখে মনে হয় যেন সেটি একটি বিশাল জেলখানা। বিশাল কাঁটাতারের বেড়া, নিরাপত্তা প্রহরীর আনাগোণা আর হিংস্র কুকুরের ঘেউ ঘেউ। আর মজার ব্যাপার হলো সেখান তেমন কোন কর্মচারী নেই। কুদ্দুস সাহেব, তিন ছেলে আর কিছু একান্ত বিশ্বস্ত লোক ছাড়া আর কাউকে কখনও সেখানে ঢুকতে ও দেখা যায় না বের হতেও দেখা যায় না।

দৈনিক মতিকন্ঠের সাংবাদিক লিপু ঢাকুরিয়া খুবই কৌতুহলী হলেন ব্যাপারটাতে। তিনি চিন্তা করলেন যে তিনি অবশ্যই এটা নিয়ে একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চালাবেন। কিন্তু কিছুতেই তিনি ফ্যাক্টরীর আশে পাশেও ভিড়তে পারছিলেন না।  হাজারটা চেষ্টা করেও মোবাইলে কুদ্দুস সাহেব বা তাঁর কোন ছেলেকে ধরা যাচ্ছে না। এতে তাঁর জেদ আরও অনেক বেড়ে গেল। একদিন সে খোঁজ পেল, ছোট ছেলে সোবহান তাঁর ভাগ্নে বুলেটকে  স্কুল থেকে আনতে মাঝে মাঝে যান। সে তখন স্কুলে অপেক্ষা করতে থাকলো এবং যেই সোবহানের গাড়ি এসে থামলো অমনি তাঁকে গ্যাঁক করে ধরলো।

ভাই, আপনাকে আমার সাথে কথা বলতেই হবে।

সোবহান খুবই বিরক্তির সাথে বললো, ধুর আপনাদের নিয়ে আর পারি না। সামান্য প্রাইভেসী বলতে কিছু নেই।

 কি করবো আপনাকে তো কোথাও পাওয়া যায় না।

 বলেন কি বলবেন। বিরসভাবে সোবহান বললো।

ভাই আপনাদের স্টীল কোম্পানীর এই রকম ফাটাফাটি অবস্থার কারণ কি?

সোবহান কিছুক্ষন মাথা নীচু করে থাকলো, তারপর বললো এটা বিজনেস সিক্রেট বলা যাবে না।

ভাই বলেন না ভাই বলেন প্লীজ। জানেন ভাই, আজকে তিন মাস ধরে ঘুরতেছি। অফিস থেকে আসাইন্টমেন্ট দিছে। নইলে চাকরি থাকবে না। প্লীজ ভাই আমাকে বাঁচান। আকুতি ঝরে পড়ে লিপুর কন্ঠ থেকে।

সোবহান লিপুর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন। তারপর মোবাইলটা বের করে ফোন করল।

বাবা কি করব, এই সাংবাদিক তো দেখি বিচ্ছু একেবারেই ছাড়ছেনা। নীচু কন্ঠে কথা বললো বেশ কিছুক্ষন সোবহান।

আচ্ছা শুনেন বেশী কিছু বলতে পারবো না, শুধু এটাই বলছি, আমাদের ইস্পাত তৈরির প্রধান কাঁচামাল হলো গম।

গম?  হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো লিপু।

জি হাঁ গম।

পরের দিন প্রধান শিরোনাম মতিকন্ঠের “ গম দিয়া ইস্পাত তৈরী কুদ্দুস গ্রুপের সাফল্যের মূলরহস্য”। দেশের সবাই ব্যাপারটা জেনে খুবই চমৎকৃত হল।

এদিকে কুদ্দুস গ্রুপের ইস্পাতের রমরমা ব্যবসা চলতে থাকল। স্টীল বা ইস্পাত তো সব শিল্প বা কল কারকারখানায় কম বেশি লাগে। কুদ্দুস স্টীলের দাম অনেক কম হওয়ায় বহু পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেল। তাতে লোকজন কম খরচে অনেক জিনিস কিনতে পারলো। জীবন যাত্রার মান অনেক বেড়ে গেল।

কিন্তু কামাল বা তাঁর মত শ্রমিকদের জন্য ব্যাপারটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। কামাল কাজ করতো সাইয়েদানা স্টীল কোম্পানিতে যারা কুদ্দুস স্টীলের সাথে পাল্লা দিয়ে পারলো না বলে বন্ধ হয়ে গেল। ফলে তিন বাচ্চার আর বউয়ের সংসারে সে বেকার হয়ে পড়লো আর প্রতিদিন কুদ্দুস স্টীলকে অভিশাপ দিতে থাকল।

এর মধ্যে দেখা গেলো কুদ্দুস স্টীল ইস্পাত ব্যবসায় মোটামুটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। বিশাল ইস্পাত সাম্রাজ্য তাঁরা এর মধ্যে গড়ে তুলেছে আর কাঁচামাল হিসেবে প্রচুর গম লাগছে। ফলে অনেক বেকার তরুনরা গম চাষে মন দিল। দেশের জল কাদা গমের জন্য একেবারে সোনায় সোহাগা। সামান্য যত্ন করে চাষ করলেই ফলন উপচে পড়ে। সেই বাড়ন্ত গম বিক্রি করে দেশের অনেক সংসার অনেক দিন পরে একটু প্রাচুর্যের মুখ দেখতে পেল।

কামালের স্ত্রী একদিন এসে বললো, এই শুনছো, মোষের মত সারাদিন হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে না থেকে একটু কিছু একটা কর। পাশের বাড়ীর হামিদের ও তো তোমার মতই চাকরি চলে গিয়েছিল। এখন তো দেখি সে দেশের বাড়িতে গিয়ে গম চাষ শুরু করে দিল। মাত্র গতমাসে ফসল তুলল। একেবারে লালে লাল হয়ে গেছে নাকি। ওর বউ নতুন শাড়ী পরে এসে কি গল্প।

কামাল এক সপ্তাহের মাথায়  হাতিমতলায় তাদের পড়ে থাকা জমিতে গম চাষ শুরু করে দিল। এরকম কামালের মত আরো যাদের চাকরি নেই তারাও গম চাষে আসতে লাগল। গমের প্রচুর উৎপাদন তাদেরকে প্রচুর লাভের মুখ দেখালো।আর মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটায় তারা আরো নতুন নতুন জিনিস কিনতে চাইল। ফলে আরো অনেক নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে গেল। সেগুলোতে কামালের মত অন্য যার চাকরী হারিয়েছিল তাঁরা অনেকে চাকরী পেল।  

এদিকে লিপু ঢাকুরিয়া কিন্তু কুদ্দুস স্টিল মিলের কথা ভুলতে পারেনা। তার ঝিঙ্গেতলার বাসা থেকে মতিকন্ঠের অফিসে যেতে যেতে পথে পড়ে হবুরাম স্টীল মিলসের গ্লোবাল হেডকোয়ার্টার। আধুনিক শিল্প সাম্রাজ্যের এই প্রতীকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও চিন্তা করে কি করে সামান্য গম ব্যবহার করে হবুরাম এই পর্যায়ে গেল। আর কেনই বা তাদের এত গোপনীয়তা? কেন এত শত শত ক্যামেরা আর নিরাপত্তা? টেকনোলজী চুরি হয়ে যাওয়ার ভয়? তাতো হতে পারে না। পেটেন্ট নিয়ে নিলেই তো হয়। নিশ্চয়ই অন্য কিছু একটা ব্যাপার আছে। ব্যাপারটা মাথা থেকে সে কিছুতেই সরাতে পারে না।

রাত দু’টো বাজে। দুরবর্তী একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। লিপু এখন হবুরাম গ্লোবাল হেড কোয়ার্টারের ভিতরে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে এখানে ঢুকতে হয়েছে। এক  কর্মচারীকে অনেক টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে তার ইউনিফর্ম আর আইডি কার্ড নিয়ে সে ভিতরে ঢুকেছে। ঢুকে তো সে বেজায় অবাক।  সে আশা করেছিল অনেক মেশিনের আওয়াজে জায়গাটা গমগম করতে থাকবে। কিন্তু কোথায় কি! সারি সারি  বড় বড় বাক্স ছাড়া সেখানে আরে কিছু নেই। কিছু লোকজন শুধুমাত্র বড় বড় ক্রেনে করে বিশাল বিশাল বাক্স গুলো এক জায়গা থেকে আরেকজায়গায় সরাচ্ছে! 

লিপু আরেকটু এগিয়ে গেল গুঁড়ি মেরে। একটা বাক্স খুব কাছাকাছি যাচ্ছে, লিপু লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করলো। অনেক কিছুই লেখা আছে কিন্তু একটা জায়গার লেখা দেখে সে তাঁর হার্টবিট মিস করলো। লেখা হচ্ছে  ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রেংথ স্টীল, মেইড ইন বুলমেনিয়া। একি! বুলমেনিয়া তো হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টীল প্রস্তুতকারী দেশ। পৃথিবীর শতকরা ৬০ ভাগের ও বেশী স্টীল বুলমেনিয়াতে তৈরী হয়। বুলমেনিয়ার ইস্পাত এখানে কি করছে? বোকার স্বর্গের শিল্প আইন অনুযায়ী তো ইস্পাত আমদানী বা রপ্তানী সম্পূর্ণ রকম নিষেধ। এটা তো দেখি  এক দুই বাক্স ইস্পাত নয়, হাজার হাজার বাক্স।

লিপু আরেকটু এগিয়ে গেল। দেখল যে সব বাক্সগুলোকে ক্রেনে করে টেনে নিয়ে আরেকটি ডকিং স্টেশনে রাখা হচ্ছে। সেখানে একটা স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে বাক্সগুলো খুলে ইস্পাতের পাতগুলো আরেকটি বাক্সের মধ্যে ঢুকানো হচ্ছে। বাক্সগুলোর সবগুলোর গায়ে  কুদ্দুস এন্ড সন্স স্টীল মিলস এর ছাপ মারা।

একতলার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। দোতলায় তাহলে কি? লিপু আস্তে আস্তে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠার সময়ে একজন ম্যানেজার টাইপের লোক নেমে আসছিল। লিপুর হাত পা হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে আসছিল। ম্যানেজার এমন হন্তদন্ত হয়ে নামছিল যে তাঁর দিকে তাকানোর ও প্রয়োজন মনে করলো না। লিপু ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

ওমা, দোতলায় ও দেখি একই কান্ড। সারি সারি বাক্স। এগুলোর গায়ে লেখা সুপার ফাইন হুইট, ডেস্টিনেশানঃ বুলমেনিয়া।

হঠাৎ করে লিপুর কাছে সব কিছু দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো। কুদ্দুস ইস্পাত কারখানা যা করছে তা হচ্ছে পুরোপুরি জালিয়াতি। তারা গম দিয়ে মোটেই ইস্পাত তৈরী করছে না। তারা গম রপ্তানী করছে বুলমেনিয়ায়, বুলমেনিয়ার জলবায়ু এবং মাটি একেবারেই গমের জন্য উপযুক্ত নয়। সেই রপ্তানীর টাকা দিয়ে তারা অত্যন্ত সস্তায় ইস্পাত আনছে।

এরপর যেদিনই বিশেষ সংখ্যায় এই চার পৃষ্ঠার অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হলো, তখন চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গেল কুদ্দুস গ্রুপের বিরূদ্ধে। 
পরের দিনই ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের স্পেশাল টীম যেয়ে কুদ্দুস আর তাঁর তিন ছেলেকে ধরে নিয়ে আসলো। এরকম বিশাল জালিয়াতির ফলে আদালত কোন রকম অনুকম্পা প্রদর্শন করলো না কুদ্দুস মালিক পক্ষকে। তাদের সবার পাঁচ বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ৫০ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছর কারাদন্ড।  

এরপরের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকলো একেবারে অনুমিত ভাবে। মালিক পক্ষের অবর্তমানে  কুদ্দুস গ্রুপ আস্তে আস্তে দেনার দায়ে বন্ধ হয়ে গেল। আর কুদ্দুস স্টীল বাজার থেকে চলে যাওয়ার ফলে অন্যান্য ছোট ছোট ইস্পাত কারখানাগুলো আবার চালু  হলো। কিন্তু তারা আগের মতই অনেক বেশী দামে ইস্পাত বিক্রি করতে লাগল।  ফলে যেসব কারখানায় ইস্পাত কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হতো সে সব জায়গায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেল এবং সে সব জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেল। দেশের লোকজনকে বেশি দামে জিনিস কিনতে হওয়ায় জীবন যাত্রার মান কমে আগের পর্যায়ে চলে আসতে থাকলো।

কিন্তু তাতে লিপু ঢাকুরিয়ার তেমন কিছু এসে যায় না। লিপু ঢাকুরিয়া কুদ্দুস গ্রুপের জালিয়াতির উপর রিপোর্ট করে সেই বছর রিপোর্টার্স ফোরামের বিশেষ পদক পেয়েছে। সে প্রায়ই তাঁর সাংবাদিক জীবনের এই সাফল্যের কথা চিন্তা করে বিশেষ তৃপ্তির ঢেকুর তুলে। যদিও ইস্পাতের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন ফ্ল্যাটটা তাকে প্রায় দেড়গুন দাম বেশী দিয়ে কিনতে হয়েছিল।

কামাল দেখলো কুদ্দুস স্টীল মিলস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তাঁর খুবই লাভজনক গমের ব্যবসা আর ভাল যাচ্ছেনা। তাই সে একদিন পাততাড়ি গুটিয়ে আবার ফিরে গেল কম বেতনের ইস্পাত কারখানার মজুরের কাজে। এখন সে গালিগালাজ করতে থাকে লিপু ঢাকুরিয়া আর তাঁর পত্রিকাকে তাঁর এতো চমৎকার গমের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য।

আর কুদ্দুস সাহেব জেলে বসে চিন্তা করতে থাকে তার বড় ছেলেকে অর্থনীতিবিদ বানিয়ে কি ভুলই না সে করেছে। ইদ্রিসই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল এই ইস্পাত আমদানী আর গম রপ্তানীর কথা, যেটা হলো মুক্ত বাণিজ্যের মুল মন্ত্র। কি কুক্ষনে না তার কথা শুনেছিল। এখন বুড়ো বয়সে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। হায়রে পোড়া কপাল। হায়রে অর্থনীতি!

বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১১

দুষ্ট সিপিডি কোথাকার!



অর্থমন্ত্রী সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) নামক প্রতিষ্ঠানটিকে দুষ্ট বলেছেন। অনেকেই অনেককে অনেক কারণে দুষ্ট বলে থাকেন। আমি যেমন আমার ছেলেদেরকে অনেক সময় বলি, তোমরা কিন্তু অনেক দুষ্ট হয়েছ। তেমনি শিক্ষক বলতে পারেন কোন ছাত্রকে, এই ছেলে! তুমি কিন্ত এই ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে! আবার একটা রোমান্টিক দুষ্টও হতে পারে, যেমন, ছিঃ যাও, দুষ্টু কোথাকার!

একটি দেশের অর্থমন্ত্রী যখন সিপিডি র মত একটা হাই প্রোফাইল গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে দুষ্ট বলেন সেটা অবশ্যই উপরের কোন দুষ্টর মত কোন ক্যাটাগরিতে পড়ে না। অবশ্যই এটা একটি অতি গুরুতর দুষ্ট। হুমম,  যথেষ্ট চিন্তার ব্যাপার। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার।  

প্রথম আলোর জুন ৬ , ২০১১ এর রিপোর্টে আছে মাননীয় অর্থমন্ত্রী বলেছেন সিপিডির বক্তব্য ‘অত্যন্ত অন্যায়, দুষ্ট এবং টোটালি রাবিশ’। আচ্ছা তাহলে ব্যাপারটা আরও অনেক বেশী গুরুতর। দুষ্ট এর সাথে এখন যোগ হয়েছে অন্যায় এবং রাবিশ। ধ্যাত, সিপিডি এটা কি করলো? দুষ্ট তাও মানা যেতো। কিন্তু অন্যায়, রাবিশ? কোনভাবেই মানা যায় না।

এই দুষ্ট, অন্যায় এবং রাবিশ ব্যাপারটা হলো যে সরকার ঘোষনা করেছে যে এই বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৬.৬৬ শতাংশ। আর দুষ্ট সিপিডি বলছে যে প্রবৃদ্ধির হার কোনভাবেই ৬ দশমিক ২ থেকে ৩ শতাংশের বেশী হওয়ার কথা না।

অর্থমন্ত্রীর কথায় আমি মোটেই বিস্মিত নি। এটা অবশ্যই একটা অতি দুষ্টামির পরিচয়। কেন কোন সাহসে সিপিডি এরকম দুষ্টামি করে? সিপিডি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আই এম এফ এর মত একটি আন্তর্জাতিক মাপের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু একটা দেশীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে কিভাবে দেশের সরকারী মাপজোকের বিরোধিতা করে এটা অর্থমন্ত্রীর বোধগম্য নাও হতে পারে। এমনিতেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, শেয়ার বাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রী একটা চাপের মধ্যে আছেন। তারপর যদি আবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে কেউ ঝামেলা তৈরী করে তাহলে কেমনটা লাগে? দুষ্ট সিপিডি কোথাকার!

সিপিডির বক্তব্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কানে পৌছালে তিনি বলেন যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জিডিপির প্রবৃদ্ধি হিসাব করে এবং এটার সাথে সরকারের কোন দ্বিমত নাই। ঠিকই বলেছেন। বিবিএস একটা সরকারী প্রতিষ্ঠান তার সাথে সরকারের দ্বিমত তো থাকার কথা থাকার না।
কিন্তু কি আশ্চর্য ! একটু পরেই তিনি আবার বলছেন যে গত বছর বিবিএসের হিসাবের সাথে মন্ত্রণালয় দ্বিমত পোষন করেছিলেন। আচ্ছা! তাহলে কোন কোন সময় সরকার আরেকটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে দ্বিমত পোষণ করে। সুতরাং ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার কখন দ্বিমত পোষণ করে আর কখন করে না।

সিপিডি টাইপের ‘রাবিশ’ কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা শুনে মনে হচ্ছে সরকার তখনই দ্বিমত পোষণ করে যখন প্রবৃদ্ধির হার তার পছন্দসই হয় না। সেটা করার অবশ্যই সরকারের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আমার যদি কিছু পছন্দ না হয় তাহলে তো আমি দ্বিমত পোষণ করতেই পারি। আমার যদি বাসার দেয়ালের রঙ পছন্দ না হয় তাহলে তো আমি সেটাতে দ্বিমত পোষণ করে বদলাতে পারি। তেমনি জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পছন্দ না হলে সেটাও আমি বদলাতে বলতে পারি। দুষ্ট সিপিডি অবশ্য বলবে যে জিডিপি আর বাসার দেয়াল তো এক হলো না। এইসব দুষ্ট এবং রাবিশ কথায় আমরা একেবারেই কান দেইনা। এই দেশটাকে আমরা আমাদের বাসার মতই নিজের এবং আপন বলে মনে করি।

গত বছর কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর একেবারে পছন্দ হয়নি কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব যেটা বিবিএস করেছিল। আমরা শুনেছি যে সেটা তিনি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ব্যক্ত করতে দ্বিধা বোধ করেননি। তিনি নাকি বিবিএস এর কর্মদক্ষতার উপর বিশেষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এটা তিনি বলতেই পারেন। কারণ বিবিএস এর কর্মদক্ষতার উপর অনেকের অল্প বেশী সন্দেহ আছে। অনেকেই প্রায় সময়ই গরমিল খুঁজে পান।  তাঁহলে তো সরকারকে কোন রকম ভাবেই দোষ দেয়া যাচ্ছে না। অবশ্য সিপিডি এর মতো কিছু কিছু দুষ্ট প্রতিষ্ঠান বলতে পারে সরকারের তখনই বিবিএস এর কর্মদক্ষতার উপর আস্থা চলে যায় যখনই দেখা যায় যে সেটা তাদের আশানুরূপ উচ্চ মাত্রার হচ্ছে না। বিবিএস তখন দ্রুততার সাথে তাঁদের ভুল বুঝতে পারে এবং সরকারী সন্তুষ্টি অনুযায়ী তাঁদের হিসাব নিকাশ সংশোধন করে তখন ততোধিক দ্রুততার সাথে সরকারের আস্থা বিবিএস এর উপর ফিরে আসে! খুবই স্বাভাবিক নয় কি? আমার আস্থা তাঁর উপরেই থাকবে যে আমার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করবে। আমি বলবো একটা আর করবে আরেকটা, এরকম কারও উপর কি কোন আস্থা রাখা যায় নাকি?  

পরিশেষে এটাই বলব যে, সরকার এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনারা একেবারেই এইসব দুষ্ট লোকের দুষ্ট কথায় কান দিবেন না। আপনারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন এবং এই দেশ এখন সম্পূর্ণ আপনাদের। আপনারা এখন  আপনাদের জন্য যা কিছু মংগল তা নির্দ্বিধায় করতে পারেন। যদি মনে করেন জিডিপির প্রবৃদ্ধি আরও দশমিক দুইতিন ভাগ বেশী হলে ভাল হয়, তবে তাই হোক। যদি মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলে ভাল হয়, তবে তাই হোক।  কে কি সব দুষ্ট, অন্যায় এবং রাবিশ কথা বলছে তা একেবারেই আমলে নিবেন না। এগুলো সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবেন। দেখবেন এভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দশমিক এক দুই ভাগ তো কোন ব্যাপারই না,  কিছুদিনের মধ্যেই ভারত বা চীনের ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি আমাদের নাগালের মধ্যে চলে আসবে।

রবিবার, ৫ জুন, ২০১১

একটি গাড়ী ভাংগার গল্প


                
কাওরান বাজার মোড়ে কিটিদের গাড়ী জ্যামের মধ্যে আটকা পড়ে গেল। উফ, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে একঘন্টা এখানেই আটকে পড়ে আছে। কালকে আবার হরতাল। তাই আজকেই সারিকার বাসা থেকে বাংলা ফার্স্ট পেপারের নোটগুলো নিয়ে আসতে হলো। নয়তো ও আবার পরশুদিন চিটাগাং চলে যাচ্ছে। মা কিছুতেই রাজী হচ্ছিলো না। বারবার যেতে মানা করছিল, হরতালের আগের দিন নাকি গোলমাল হতে পারে। এটা অবশ্য একটা নতুন ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। হরতালের আগের দিন ভাংচুর। কিন্তু আম্মু এতো মানা করলেও উপায় তো ছিলনা। নোটগুলো না পেলে এস এস সি র প্রিপারেশন বেশ পিছিয়ে যেত।  যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারলেই বাঁচি। আশে পাশে নিশ্চল গাড়ীর জংগলে কিটি  অবশ্য এই ব্যাপারে খুব একটা আশান্বিত হতে পারছিল না।

জাহিদ চিন্তা করলো আর দেরী করাটা ঠিক হবে না। পান্থপথের মোড়ে সাঈদ রেডি গোটা দশেক সোলজার নিয়ে। আর এফডিসির দিকটা কাভার করছে কালাম আরো গোটা পনের নিয়ে। তার সিগন্যাল পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর পুলিশের ব্যাপারটা বস দেখছেন। বলছে কোন ব্যাপার না। পুলিশ ১৫/২০ মিনিটের আগে কোন কিছুই করবেনা। জাহিদ তার আগেই তার বাহিনী নিয়ে চম্পট দিতে পারবে। গাড়ী পোড়ানোটা ইদানীং একটু  ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে গ্যাস সিলিন্ডার থাকায়। একবার ফেটে যেয়ে তো সেলিমের এক সোলজার প্রায় তিনমাস হসপিটালে ছিল। বেচারার ডান পা একেবারে উড়েই গিয়েছিল বলা যায়। 

গাড়ী সবসময় পোড়াতে না পারলেও ভাংচুরটাও কম আনন্দদায়ক নয়। গাড়ী ভাংগার আলাদা একটা আমেজ আছে। হকি স্টিকের  বাকাঁনো ধারটা যখন দমাস করে গাড়ীর সামনের কাঁচটিতে পরে আর তাতে কাঁচের মধ্যে প্রথমে একটি নকশার মত তৈরি হয় মনে হয় যেন কোন এক মহান শিল্প কর্ম। তারপর সেটি একসময় চুরচুর হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। সাথে সাথে যে একটা তীব্র আতংকের ছায়া সবার চোখে মুখে ফুটে ওঠে  তা দেখে নিজেকে ঈশ্বরের মত মনে হয়। গাড়ীতে প্যাসেঞ্জার হিসেবে নারী এবং শিশুরা থাকলে  জমে আরো ভাল। তাদের তীব্র চিৎকার ভয়ংকর একটা পরিবেশের আমেজ খুব সহজেই এনে দেয়। তারপর সেটা যখন  আলোর চেয়েও তীব্র গতিতে চারিদিকে সংক্রমিত হয়ে যায় তখন মনে হয় এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে।

জাহিদের বেশ ভাল একটা সুশিক্ষিত দল আছে। অনেকগুলো গাড়ী ভাংগায় অংশগ্রহন করে তারা মোটামুটি বেশ ভাল হাত পাকিয়েছে। শুরুর দিক পঞ্চাশটার মত গাড়ী ভাঙ্গতে প্রায় আধাঘন্টার মত লেগে যেত। ততক্ষনে পুলিশ এসে মোটামুটি বেশ ভালই ঠেঙ্গানো শুরু করতো। বেচারা গিট্টু গালিবের তো কব্জির গিটটাই খুলে গেল মোটা লাঠীর এক মোক্ষম বাড়ি খেয়ে। এখন মোটামুটি ১৫-২০ মিনিটের বেশী সময় লাগেনা। কলেজে পড়ার সময় এক সময় শখের বশে আর উত্তেজনার নেশায় গাড়ী ভাংতো। এখন এটা মোটামুটি একটি পেশায় পরিণত হয়েছে। এবং বেশ নিরাপদ পেশা।

জাহিদ আগে গাড়ী ভাংতো বিরক্তিকর জীবনে কিছুটা উত্তেজনা খোঁজার জন্য। ক্লাসে কি সব হাবি জাবি পড়ানো হত তা নিয়ে জাহিদ মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করতো না। ক্যান্টিনের পিছনে তাসের আড্ডার পাশাপাশি ফেন্সিডিলের বোতলের প্রতিই তার আসক্তি বেশী ছিল। মাঝে মাঝে যখন খবর আসত যে মার্কেটে কোন কর্মচারীর সাথে কলেজের কোন ছাত্রের সংঘর্ষ হয়েছে তখন মারদাঙ্গা ছাত্রদের সাথে মার্কেট ভাংচুর এবং সেই সাথে মার্কেটের সামনে পার্ক করা গাড়ীর উপর এক পৈশাচিক উল্লাসে  জাহিদ ঝাপিয়ে পড়তো। গাড়ী গুলো কি অপরাধ করেছে সেটা নিয়ে অবশ্য তার মাথা ঘামানোর কোন কারণ ছিল না। সে শুধু জানতো কোন একশনে গেলেই  গাড়ী ভাঙ্গতে হবে।

গাড়ী ভাঙ্গাটা নিয়ে তার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সে একটা জিনিস শিখেছে। গাড়ী ভাংগাটা আমাদের সমাজে তেমন একটা গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না।  গাড়ী জিনিসটা এখনও দেশের উপর তলার বড়লোকদের একটি প্রতীক বলেই গণ্য করা হয়। উপরতলার মানুষদের এরকম দু’তিনটা গাড়ী পুড়লে আর কি এসে যায়। এগুলো অবশ্য তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত হয় নাই। একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা যার ছত্র ছায়ায় জাহিদ কাজ করে তার মুখ থেকে শোনা। 

“বুঝলি জাহিদ, নিশ্চিন্তে গাড়ী ভাংবি, গাড়ী ভাংলে এই দেশের লোকজন আসলে কিছুই বলবে না।কিন্ত গাড়ী ভাংলে তুই সহজেই একটা আতংক সৃষ্টি করতে পারবি যা অন্য কিছু করে করে এত সহজে করা যায় না। আর মজার ব্যাপার হলো এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে গাড়ী ভাংলে তোর বিরাট কোন শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বড়জোর পুলিশের দুই তিনটা লাঠীর বাড়ি টাড়ি খাইতে পারিস। এ পর্যন্ত কাউকে দেখছিস গাড়ী ভাংগা বা পোড়ানোর জন্য বিশাল কোন ধরা খাইতে? “ জাহিদ মাথা নেড়ে বলেছে একদম সত্যি কথা। সে এখনও পর্যন্ত দেখে নাই। প্রথম আলোর একদম প্রথম পাতায় ছবি সহ রাজুকে দেখা গেছিলো একটা টয়োটা প্রিমিওর উপর উঠে    লাঠী উচিয়ে রেখেছে। তারপরও রাজুকে শুধুমাত্র কয়েকদিন ডেমরার দিকে পল্টা কামালের বাসায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। এখন তো সে আবার নির্বিকার ভাবে এলিফ্যান্ট রোডে চাঁদাবাজি করছে এবং এই তো গত মাসে ঢাকা কলেজের সামনে একটা   অ্যাকশনে দুইটা করোলা আর একটা নিশান একাই পুড়িয়েছে।

এতদিন জাহিদ বিবেকের মাঝেমধ্যে বিবেকের সামান্য খচখচানি ছাড়া বেশ আত্মতৃপ্তির সাথেই গাড়ি পুড়িয়ে এসেছে। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত হল  মাস ছয়েক আগে তাঁর বোনের বাসায় যাওয়ার পর থেকে। তার বোন থাকে কাঁঠাল বাগানের ঢালের কাছে...............

জাহিদ বাসায় ঢুকেই দেখলো আপ্পি সোফায় শুয়ে বই পড়ছে। জাহিদকে দেখেই একটা উৎকন্ঠা আর এক রাশ অনুযোগের ছায়া চোখের মাঝে। “কিরে জাহিদ এতদিন পরে আসলি? আশ্চর্য ব্যাপার! কিটি তো খালি বলে  মামা আর আসে না কেন...মামা আসে না কেন...আশ্চর্য...ফোন করলেও ধরিস না। ফোন টা আছে কি জন্য...ব্যাপারটা কি...এই রকম কেন তুই? “ আপ্পি হড়বড় করে  বলে গেলো।

জাহিদ কিছু না বলে সোফায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলাতে লাগলো।
“কিছু না বলে বেয়াদবের মত চুপ করে বসে আছিস কেন?”
জাহিদ পত্রিকার পাতা থেকে চোখ না তুলেই বললো, “কি বলবো?”
আপ্পি সোফার হাতলের পাশে এসে দাঁড়ালো। একটু চিন্তার ছায়া তাঁর চোখে।
“জাহিদ কিছু হয়েছে নাকি রে? এরকম লাগছে কেন তোকে?” 
“কিছু না আপ্পি, কিটি কোথায় রে?” জাহিদ উঠে কিটির রুমের দিকে রওনা দিল। আপ্পি কিছুক্ষন জাহিদের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকল। তারপরেই তাসলিমাকে দেখেই সম্পূর্ণ অকারণে একটা ধমক দিল “এই দেখিস না যে মামা এসেছে, তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে যা !”

আপ্পির একমাত্র মেয়ে কিটি তো মামা বলতে অজ্ঞান। দুলাভাই যখন বিদেশে ছিলো দু’বছর পোস্ট ডক্টরেট করতে যেয়ে, জাহিদই তখন কিটির দেখাশোনা করতো আপ্পি যখন স্কুলে পড়াতে যেতো।

“মামা!” কিটির মিষ্টি গলার  আহ্ললাদ মেশানো চিৎকারটা আরও অনেক মিষ্টি হয়ে শোনালো অনেক দিন বাদে শোনার ফলে! “জানো জানো আমরা না একটা গাড়ী কিনছি!” কিটির মুখে হাজার ওয়াটের বাল্বের আলো যেন ফেটে পড়ছে।

“তাই নাকি রে, হঠাৎ করে?” জাহিদ বেশ বিস্মিত।

“হ্যাঁ মামা, জানো না তো, নেক্সট উইকের মধ্যেই চলে আসবে।

“ওরে বাবা, এতো তাড়াতাড়ি? আমি তো কিছুই জানিনা”।

“তা জানবি কি করে? তোর কি আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়ার কোন দরকার আছে?” জাহিদের প্রিয় গরম গরম কুরবানীর মাংস দিয়ে বানানো সমুচা নিয়ে আপা ঢুকতে ঢুকতে বললো।

“একবার গায়েব হলে বেঁচে আছিস না মরে গেছিস তাও জানার উপায় থাকেনা। তোকে এতবার ফোন করে না পেয়ে প্রভোস্টের কাছে ফোন করলাম। তিনি কেমন যেন ঠান্ডা ভাবে কথা বললেন। হ্যারে তুই কি কোন ঝামেলায় করেছিস নাকি? হলে থাকিস...কত রকম ঝামেলা...”

“গাড়ীর ব্যাপারটা কি? হঠাৎ করে? দুলাভাই কি কোন হেরোইন স্মাগলার পার্টির সাথে জয়েন করলো নাকি? এত মাল পাত্তি?” জাহিদ দ্রুত প্রসংগ বদলানোকেই শ্রেয় মনে করলো।

“আরে আরে বলিস না, তোর দুলাভাইয়ের যদি হেরোইন স্মাগলিং করারও মুরোদ থাকতো তাহলেও একটা কথা  ছিলো। সারাদিন মোটা মোটা বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা, দু’কলম লেখা আর ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো ছাড়া ওর আর কি করার আছে?” আপ্পি দুলাভাইয়ের প্রতি তাঁর এই চিরন্তন ক্ষোভ দেখানোর সুযোগ কখনই ছাড়ে না।  জাহিদ এতে ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।

“তাহলে হঠাৎ করে এতগুলো টাকা...”

এত বছর ধরে ঘোড়ার ডিম কি লেখালেখি  করছে আল্লায় জানে, শেষ বয়সে এসে নাকি মোটামুটি ভাল একটা রিসার্চ গ্র্যান্ট থেকে একটা প্রজেক্ট শেষ করেছে। সেখান থেকে এই সবেধন নীলমণি টাকা। টাকা পেয়েও কি শান্তি...  ফ্ল্যাটের বুকিং দেয়া হবে নাকি গাড়ী কেনা হবে সেই নিয়ে প্রতিদিন আমার আর তোর দুলাভাই এর ঝগড়া। এই ভাড়া বাসায় আর কতদিন? বাড়ীওয়ালার সাথে পানি নিয়ে, ময়লা ফেলা নিয়ে, গেইট নিয়ে এত ঝামেলা …… কিন্তু তার কথা হলো কিটির জন্য গাড়ী কিনতে হবে। এটা ঠিক কিটিকে নিয়ে…. একটু সমস্যা….।“ আপ্পি একটু অস্বস্তির সাথেই বললো।

জাহিদ কিটির দিকে আড়চোখে তাকালো। কিটির সজীব মুখমন্ডলে হঠাৎ করে কালো মেঘের ছায়া। “কেন কি হয়েছে...কিটির?” জাহিদ সাবধানী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল!

 “আর বলিস না, পাড়ার ওই লুচ্চা বদমাইশ লিটন, ছোটবেলা থেকেই আমার মেয়েটার দিকে তার নজর, একদিন তো রিক্সা থামিয়ে..” আপ্পির কন্ঠ হঠাৎ করে বেশ কেঁপে গেল।

“রিক্সা থামিয়ে কি...” জাহিদ জিজ্ঞেস করতেও ভয় পাচ্ছিল। কিটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছ।

“রিক্সা থামিয়ে হাত ধরে ওকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিল...আমার   
মেয়েটাকে...আমার মেয়েটাকে...জোর করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল...ওই শয়তান লিটন...” আপ্পির গলাটা ধরে আসে। কিটি এই পর্যায়ে হঠাৎ করে উঠে চলে গেল।
“তখন ভাগ্য ভালো মানিক স্যার মাত্র বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ের দোকানে যাচ্ছিলেন। ঘটনা দেখে তিনি যেই এগিয়ে গেলেন অমনি বদমাইশের দল পালালো।“

“লিটনের বাসায় জানানো হয় নাই?” জাহিদের মাথা দপদপ করে জ্বলছে।

“তোর দুলাভাই, মানিক স্যার আর পাড়ার কয়েকজন সেদিন সন্ধ্যায়ই ওদের বাসায় গিয়েছিল। তার বাবা বাসায় ছিলো না। আর লিটন তো গায়েব। তার মা কি বলল জানিস? বললো যে আপনার মেয়েরই তো সমস্যা। সমত্থু মেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন।“

“এই ঘটনার পর আমি মোটামুটি ফ্ল্যাটের আশা পার্মানেন্টলি ছেড়ে দিলাম। ধুর কি হবে নিজের  ফ্ল্যাটে থেকে, যদি একটু শান্তিতে নাই থাকতে পারি। তোর দুলাভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে । রিক্সা আর বাসে  যাওয়া আসে করতে থাকলে এই লিটন শয়তানটা আবার কবে যে কি করে। এই জীবনে মনে হয় আর কোনদিন নিজের একটা বাড়ি হবে না।“ আপুর কন্ঠটা কেমন যেন একটা হাহাকার ধ্বনির মত শোনা গেল।

“আপু, একটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম না। গাড়ী আর বাড়ীর দাম তো এক নয়। গাড়ী কিনার পয়সা দিয়ে কি বাড়ী...”

“আরে তা কি আর হয়। অ্যাট লিস্ট ডাউন পেমেন্টটা তো দেয়া যেতে পারে। আর আমার ননদের চাচাতো ভাই এক বড় ডেভেলপার কোম্পানীর সাথে আছে। ডাউন পেমেন্টা দিতে পারলে অনেক ফ্লেক্সিবল ভাবে ইন্সটলমেন্ট দেয়া যেতো আস্তে আস্তে অনেক দিন ধরে। “ আপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।

জাহিদ কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না। তাই সোফার কোনাটার দিকে তাকিয়ে থাকাটাকে সে শ্রেয় মনে করল।

 হলে ফিরে সে কেন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। রাতের খাবারের সময় খামাখাই ডাইনিং এর বয় দেলোয়ারকে একটা চড় লাগালো ডাল আনতে দেরী করার জন্য। রাতে যখন সামসু আসলো তাসের আসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন কিছুতেই যেতে রাজী হচ্ছিল না। অনেক জোরাজুরির পরে গেলেও সারাক্ষন গুম হয়ে থাকল।

এক সপ্তাহ পর।

আপ্পির ফোন...রিং টোন বেজেই চলেছে। উফ...আবার একগাদা বকবক...

“হ্যালো”

“মামা!” কিটির রিনরিনে তাজা কৈশোরের সজীব কন্ঠস্বর ভেসে আসল।

“কিটি কুট্টুস, কিরে কি খবর তোর?”

“মামা, তুমি জানো না, আমার কি যে ভাল লাগছে, মামা তুমি জানোনা...উফ আমি মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাবো।“ কিটি খুশীর আতিশয্যে হাঁসফাঁস করতে করতে বলে।

“তাড়াতাড়ি বল, অজ্ঞান টজ্ঞান হয়ে গেলে আবার শুনতে পারবো না।“ জাহিদ  হেসে বলল।

“মামা, তুমি জানো না, গাড়ীটা বাসায় যখন প্রথম আনলো, আমি তো মনে হয় একেবারে ফেইন্ট। ক্রীম কালারটা এতো জোস। উফ, আরে গাড়ীর ভিতরের গন্ধটা ,জাস্ট অসাধারন মামা। আমি তো গাড়ী থেকে আর বেরই হচ্ছিলাম না, ড্যাশবোর্ড টা কি ঝাক্কাস, আব্বু তো বললো আমাদের কিটিমণিকে কাঁথা বালিশ এনে দাও। ও আজকে থেকে গাড়ীতেই থাকবে।“ কিটি তার দমের শেষ বিন্দু পর্যন্ত ব্যবহার করার পর থামল।

“গাড়ী চলে এসেছে? বাহ।“ জাহিদ বেশ জোর করেই উল্লাস প্রকাশ করার চেষ্টা করল।

“হ্যাঁ মামা, ওই শয়তান লিটনটার নাকের উপর দিয়ে আমি যখন গাড়ী নিয়ে ধা করে বেড়িয়ে যাবো না, তখন বুঝবে পাজী বদমাইশটা  কত ধানে কত চাল।“ কিটির কন্ঠে একটা পরিষ্কার নিরাপত্তা মিশ্রিত তৃপ্তির ছাপ।

সেদিন রাতে জাহিদ আবার দেলোয়ারকে লবন কম দেয়ায় বিশ্রী ভাষায় গালি গালাজ করলো। তারপর  সামসুর সংগে  ক্যাটরিনা কাইফ না প্রিয়াংকা চোপড়া কে বেশী ভাল অভিনেত্রী এটা নিয়ে তর্ক করতে করতে আরেকটু হলে সামসুকে ঘুষি মেরেই বসতে গেলো।

ছয় মাস পরের কথা।

রিং টোন বাজছে। “হ্যালো”...

“হরতালের ডেট পড়ছে দেখছোস? এইবার তো কড়া হরতাল হইবো মনে হইতাছে।“ সাঈদের গলায় চাপা উল্লাস।

“কিভাবে বুঝলি? বস কিছু বলছে ?”

“বলছে মানে? হাই কমান্ড থেকে ডাইরেক্ট নির্দেশ। একদম ছাড়খাড় কইরা দিতে হইব।“

“মালপানি কি রকম?”

“দোস্ত এইবার একশন যেইরকম কড়া, মালপানি তার চেয়েও বেশী কড়া।“ এই বলে সে গলা নামিয়ে একটা সংখ্যা বললো।

“বলিস কি!”

“আরে দোস্ত এই একশনটা ভাল মত নামাইতে পারলে অনেকদিন আর কোন চিন্তা নাই। বস কিন্তু তোর কথা বার বার বলছে। বলছে যে ছেলেটার হাতের কাজ ভাল।“

...............একটা হর্ণের আওয়াজে জাহিদ সম্বিৎ ফিরে পায়। ওকে, সব রেডী মনে হচ্ছে। জাহিদ দু’টো নাম্বারে দু’টো মেসেজ পাঠালো অতি দ্রুত।  আর তাতে মুহুর্তের মধ্যে পান্থপথ একটা পৈশাচিক রণক্ষেত্রে পরিণত হল।

আহ, কি উত্তেজনা, কি দারুন। কালাম আর সাঈদের দল থেকে আসা ছেলে গুলো মন্দ নয়। দশ মিনিটের মধ্যে তারা মোটামুটি বিশ পচিশটা গাড়ী নামিয়ে ফেলেছে। আজকের গাড়ী গুলোতে বাচ্চা আর মেয়েদের সংখ্যা বেশী। তাই তাদের আতংক ভরা উথাল পাথাল চিৎকারে মোটামুটি আকাশ ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা। জাহিদ বেশ একটা সন্তুষ্টির হাসি দিয়ে তার পরবর্তী টার্গেটের দিকে এগিয়ে গেল। এই গাড়ীটা তো বেশ ঝা চকচকে মনে হচ্ছে। মনে হয় মাত্র কয়েকদিন আগে পোর্ট থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখনও পার্মানেন্ট লাইসেন্স প্লেট পায় নাই। নিসান ব্লু বার্ড সে আগে কখনও ভাঙ্গেনি। জাহিদ বেশ আগ্রহ নিয়ে গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।

গাড়ীটার কাছে আসতেই সে একটা জান্তব আওয়াজ শুনতে পেল। ড্রাইভার তার দিকে  করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছে। আর আরোহী একজন কোট-টাই ভরা ভদ্রলোক, শুন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

জাহিদ বনেটে ভর দিয়ে ছোট্ট লাফ দিয়ে উঠে পড়লো গাড়ীর উপরে। হকি স্টীকটা এক পাক ঘুরিয়ে যেই নামিয়ে আনতে যাবে অমনি তার চোখ চলে গেল দশ/পনেরোটা গাড়ি পিছনে একটা ক্রীম কালারের গাড়ীর দিকে। গাড়ীর পিছনে একটা ১৫-১৬ বছরের মেয়ে বসে রয়েছে। অবাক কান্ড, এত ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও কিন্ত সে কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে শুধু তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কালামের দলের একজন সোলজার এই মাত্র ক্রীম কালারের গাড়ীটার কাছে পজিশন নিয়ে ফেলেছে।

জাহিদ বিদ্যুৎ বেগে নিশান থেকে নেমে আসল একটা আর্ত চিৎকার দিয়ে। “এই হারামজাদা থাম। খবরদার এই গাড়ীতে হাত দিবিনা, খবরদার।“ চারিদিকের ভাংচুর আর আর্তনাদের তীব্র আওয়াজে জাহিদের চিৎকার কোথায় হারিয়ে গেল। সোলজার ততক্ষনে একটা মোক্ষম বাড়িতে উইন্ডশীল্ড চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে। ড্রাইভার বের হতেই দেখা গেলো তার মাথা থেকে অবিরাম ধারায় রক্ত ঝরছে। “আফা বাইর হন তাড়াতাড়ি, এরা মানুষ না, অহন সাইডের গেলাসে মারবো। গাড়ী ভর্তা কইরা ফালাইবো আফা! বাইর হন অক্ষনি!“

জাহিদ ছুটছে, পনের/বিশটা গাড়ির দুরত্বকে তার অনন্তকাল বলে মনে হচ্ছে। এরকম অবস্থার মধ্যেও সে একটা জিনিস খেয়াল না করে পারলো না। কিটির দৃষ্টিতে কিন্তু কোন রাগ বা ঘৃণার ছাপ নেই। তার  বড় বড় অভিমান ভরা চোখদুটো শুধু যেন বলছে, মামা তুমি এটা কি ভাবে পারলে?

পুনশ্চঃ উপরের গল্পের প্রতিটি চরিত্র এবং গল্প কাল্পনিক হলেও গল্পটি নিবেদিত বাস্তবের গাড়ী ভাংগার নায়কদের উদ্দেশ্যে। আপনি যেই কারনেই গাড়ী ভেঙ্গে থাকুন না কেন, সেটা হোক চরম আক্রোশে, নিছক উত্তেজনায় বা পেশাগত কারণে মনে রাখবেন অনেক গাড়ী এখন মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন একটি অপরিহার্য বিষয়। একটি গাড়ীর পিছনে হয়তো আছে একজন বাবা অথবা মায়ের সারাজীবনের চাকুরীর পেনশনের টাকা বা ব্যবসার পুজিঁ। এর সাথে হয়তো মিশে আছে ঢাকা নামের এই দুর্বিষহ নগরে প্রিয় সন্তানের একটু স্বস্তির সাথে চলাচলের নিরাপত্তা। একটি গাড়ী ভাংগার সাথে সাথে আপনি সেই পরিবারের অনেকগুলো স্বস্তি এবং নিরাপত্তার বাতাবরণ ভেংগে দেন, বিশাল আর্থিক ক্ষতির কথা বাদই দিলাম। পরবর্তী গাড়ীটি ভাংগার আগে ব্যাপারটি কি একটু মাথায় রাখবেন প্লীজ?